Monday, January 17, 2011

পাঁচ লাখ শ্রমিকের ধোলাই খালে বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকা আয়

পাঁচ লাখ শ্রমিকের ধোলাই খালে বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকা আয়

০০মোহাম্মদ আবু তালেব

বিশাল শিল্প সম্ভাবনাময় ধোলাইখালের লেদ শিল্পে পাঁচ লাখ শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। ধোলাইখালের লেদ শ্রমিকরা গুরুত্বপূর্ণ মেশিনারী পার্টস থেকে শুরু করে বাইসাইকেল এমনকি ট্রেনের বগি ও যন্ত্রাংশ পর্যন্ত অনায়াসে নির্মাণ করছেন। হাল্কা প্রকৌশল এই শিল্পের বার্ষিক টার্নওভার ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এই শিল্পের উদ্যোক্তারা প্রতি বছর উৎপাদিত যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ বিদেশে রফতানি করে আয় করছেন ৫০ কোটি টাকা। আর সরকারকে প্রতি বছর শিল্প উদ্যোক্তারা রাজস্ব আয় দিচ্ছেন ১৬৫ কোটি টাকারও অধিক। বিনিময়ে তারা সরকারের কাছ থেকে কোন সুযোগ-সুবিধাই পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন ধোলাইখালের ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিকরা। তারা কৃষি ও আইটি খাতের ন্যায় এই খাতকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিনা সুদে ঋণ তহবিলের (ইইএফ) আওতায় আনার দাবি জানান। তারা সম্ভাবনাময় এই শিল্পকে বাঁচানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ধোলাইখাল, উত্তর ও দক্ষিণ মৈশুণ্ডি, নবাবপুর, টিপু সুলতান রোড, বনগ্রাম, ওয়ারী ও পাশর্্ববর্তী এলাকায় এই শিল্পের বিস্তৃতি ঘটেছে। ধোলাইখাল ও পাশর্্ববর্তী এলাকায় রয়েছে ছোট-বড় অর্ধলক্ষাধিক ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ বা হাল্কা প্রকৌশল শিল্প। এখানকার শ্রমিকদের বেশিরভাগেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। নেই কারিগরি কোন শিক্ষা। হাতের অভিজ্ঞতা আর চোখের মাপে তারা নিখুঁত থেকে নিখুঁততর মেশিনারী পার্টস তৈরি করে। যুগ যুগ ধরে বাস্তব অভিজ্ঞতার শক্তিতে বলিয়ান হয়ে ধোলাইখালের শ্রমিকরা একের পর এক যন্ত্রপাতি তৈরি করে চলেছেন। তাদের তৈরি সামগ্রী দেখে হতবাক হয়ে যান।

উন্নত বিশ্বের কারিগরি জ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারী বাসিন্দাদের অনেকেই। চাহিদার প্রায় ৫০ শতাংশ পূরণ করে বিদেশেও রফতানি করছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। দেশের বাজারে এই শিল্পের এতটাই চাহিদা যে, ক্রেতারা যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য উদ্যোক্তাদের অগ্রিম অর্থ দিয়ে বুকিং দিয়ে রাখছেন। অথচ দুই দশক আগেও বিভিন্ন শিল্পখাত ও পরিবহন সেক্টরের যন্ত্রাংশের পুরোটাই আমদানি করা হতো। যন্ত্রাংশ ছাড়াও আস্ত নতুন আধুনিক যন্ত্রপাতি তৈরি হচ্ছে পুরান ঢাকার ধোলাইখালসহ বগুড়া ও যশোরের বিভিন্ন কারখানায়। বিদেশে এসব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ রফতানি হচ্ছে।

হাল্কা প্রকৌশল শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স এসোসিয়েশনের (বিইআইওএ) সভাপতি আবদুর রাজ্জাক ইত্তেফাককে বলেন, দেশি তৈরি যন্ত্র ও যন্ত্রাংশের বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রতি বছর শতাধিক আইটেম রফতানি করে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ কোটি ডলার আয় হচ্ছে। বাংলাদেশ বছরে সাত কোটি ৪০ লাখ ডলারের গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানি করছে। আর হাল্কা প্রকৌশল শিল্প থেকেই দেশের বাজারে সরবরাহ করা হয় সাত কোটি ৫০ লাখ ডলার মূল্যের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ।

বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মাহাবুবুল আলম ইত্তেফাককে বলেন, দেশে হাল্কা প্রকৌশল এই শিল্পে প্রায় তিনি হাজার আটশত রকমের যন্ত্র ও যন্তাংশ তৈরি হচ্ছে। যার মধ্যে ১৩৭টি আইটেম বিশ্বের ১৭টি দেশে রফতানি হচ্ছে। এছাড়াও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) নিবন্ধিত প্রায় দুই হাজার উদ্যোক্তা বিভিন্ন সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান সাব-কন্ট্রাকের মাধ্যমে যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ সরবরাহ করছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে, বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন, বাংলাদেশ টেক্সটাইলস মিলস কপোরেশন, সিভিল এভিয়েশন, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন, বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ড, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, বন্দর ও সমুদ্র পরিবহন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কতর্ৃপক্ষ, তিতাস, বাখরাবাদ ও জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানি, চিনি ও খাদ্য শিল্প কপোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়মিতভাবে যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা হচ্ছে।

অপরদিকে যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি করা ছাড়াও মেরামতের শতকরা ৯০ ভাগ কাজ করছে এই শিল্প। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এমডি ও পুরনো ঢাকার বাসিন্দা প্রকৌশলী মীর শওকত আলী ইত্তেফাককে বলেন, স্বাধীনতার আগে হাল্কা প্রকৌশল শিল্পে বাঙ্গালীদের তেমন অবদান ছিল না। বিহারি ও পাঞ্জাবিদের উদ্যোগে পুরনো ঢাকায় কয়েকটি ওয়ার্কশপ গড়ে তোলা হয়। অবাঙ্গালীদের প্রতিষ্ঠানে বাঙ্গালীরা শ্রমিক হিসাবে কাজ করতো। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মালিকরা শ্রমিকদের হাতে দায়িত্ব দিয়ে দেশ ছাড়ে। এভাবেই বাঙ্গালীদের একটা বড় অংশ হাল্কা এই প্রকৌশল শিল্পের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘ দিনের শ্রমে-ঘামে আজকের এই সমৃদ্ধ শিল্প সেক্টরটি গড়ে তোলেন সরকারি সহায়তা ছাড়াই।

রিনা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক মোঃ নূরুজ্জামান শেখ ইত্তেফাককে বলেন, একমাত্র সাবেক এরশাদ সরকারের আমলে শিল্প উদ্যোক্তা ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের একটি দল জাপানে কারিগরি প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছিল। সে সময় হাল্কা প্রকৌশল শিল্পের উকর্ষতা সাধনে সরকারিভাবে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পও চালু করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সরকারগুলো তা বন্ধ করে দেয়। পরবর্তী কোন সরকারই এই শিল্পের উন্নয়নে এগিয়ে আসেনি। বরং ট্যাক্স আর ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে নানাভাবে শিল্প উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সরকারের ট্যাক্স বিভাগের হয়রানির শিকার হয়ে অনেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ গুটিয়ে বিদেশে চলে গেছেন।
Source: Daily Ittefaq, 17th January-2011

No comments:

Post a Comment