Wednesday, January 5, 2011

অপার সম্ভাবনাময় ধোলাইখাল

অপার সম্ভাবনাময় ধোলাইখাল

০০ মোহাম্মদ আবু তালেব

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে পুরনো ঢাকার ধোলাইখাল। এখানে মোটর পার্টস ও ইলেকট্রনিক্স তৈরির এক বিশাল সম্ভাবনা গড়ে উঠেছে। লাইনার, পিস্টন, বেয়ারিং থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি মোটর পার্টস, গাড়ির ব্রেকড্রাম, ইঞ্জিন, কার্টিজ, সকেট, জগ, জাম্পার, স্প্রিং, হ্যামার, ম্যাকেল জয়েন্ট, বল জয়েন্টসহ নানা সামগ্রী তৈরি হচ্ছে।

ধোলাইখালে তৈরি মেশিনারি পার্টস ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ নানা দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এছাড়া ভাল রিকন্ডিশন্ড পার্টসের জন্য ধোলাইখালের দেশব্যাপী সুনাম রয়েছে। পুরনো গাড়ি ভেঙ্গে পার্টস সংগ্রহ করা হয় এখানে। ধোলাইখালের পার্টসের চাহিদা গোটা দেশে। ইতিমধ্যেই সারাদেশে সুখ্যাতি অর্জন করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশের অপার সম্ভাবনাময় এই ধোলাইখালের মেশিনারি ও পার্টস শিল্প এক সময় বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

ঢাকা বিশারদ অধ্যাপক ড. মুনতাসির মামুন ইত্তেফাককে বলেন, ধোলাইখালের উৎপত্তি মোগল আমলে সুবেবাংলার রাজধানী হিসাবে ঢাকার জন্মলগ্ন থেকে। ঢাকের আওয়াজের ব্যাপ্তি জুড়ে ঢাকা রাজধানী হওয়ার পর প্রথম সুবেদার ইসলাম খান চিশতি (১৬১০-১৩) বুড়িগঙ্গার সঙ্গে দুলাই নদীর সংযোগ স্থাপনের জন্য একটি খাল খনন করেছিলেন, যা পরবতর্ীকালে দোলাইখাল ও শেষ লোকমুখে ধোলাইখাল নামে পরিচিতি পায়। স্বাধীনতার আগে থেকেই এখানে এলাকায় মোটর পার্টস তৈরির গোড়াপত্তন ঘটে। স্বাধীনতা পরবতর্ী সময়ে ধোলাইখাল ভরাট হতে থাকে। এইসঙ্গে এখানে প্রসার ঘটতে থাকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের।

কমমূল্যে ভাল রিকন্ডিশন্ড পার্টস কেনার জন্যই ধোলাইখাল সুনাম অর্জন করেছে। বর্তমানে এ এলাকায় ছোটবড় কয়েক হাজার দোকান ও কারখানা রয়েছে। এ শিল্প ব্যবসার সঙ্গে জড়িত লক্ষাধিক শ্রমিক ও ব্যবসায়ী। ধোলাইখালের পুরো এলাকাতেই ছড়িয়ে রয়েছে পার্টস এবং ইলেকট্রনিক্স দোকান ও কারখানা। গাড়ির পার্টসসহ বিভিন্ন অংশের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা মার্কেট। মার্কেটের মধ্যে রয়েছে হাজী মনসুর 'মার্কেট', 'বাঁশপট্টি মার্কেট', 'গাছ মার্কেট' এবং 'টং মার্কেট।' হাজী মনসুর মার্কেটে প্রাইভেটকারের স্পেয়ার পার্টস, বাঁশপট্টি মার্কেটে টয়োটা, হোন্ডাসহ অন্যান্য গাড়ির পার্টস, গাছ মার্কেটে বেডফোর্ডের পার্টস, টং মার্কেটে প্রায় সব ধরনের স্পেয়ার পার্টস এবং এর পাশেই গাড়ির পুরনো টায়ার ও রিম পাওয়া যায়।

এসব মার্কেটে প্রায় সব ধরনের প্রাইভেটকার, বাস ও ট্রাকের স্পেয়ার পার্টস পাওয়া যায়। সুলভমূল্যে ভাল রিকন্ডিশন্ড পার্টস কিনতে গাড়ির মালিকরা বাধ্য হয়েই ধোলাইখাল যান।

ধোলাইখালের ব্যবসায়ীরা জানান, এসব পার্টস বিভিন্ন মোটর গ্যারেজ থেকে সংগৃহীত এবং কিছু জিনিস নিজস্ব কারিগরি দক্ষতায় তৈরি করা হয়। পুরনো গাড়ি ভেঙ্গেও পার্টস সংগ্রহ করা হয়।

ধোলাইখালের রীনা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক হাজী নূরুজ্জামান শেখ বলেন, তার প্রতিষ্ঠানটি মোটর গাড়ির সব ধরনের পার্টস মেরামত ও গাড়ির ২৫ শতাংশ যন্ত্রপাতি তৈরি করে থাকে। তিনি বলেন, দেশের চাহিদা মিটিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি যন্ত্রাংশ পাশর্্ববর্তী দেশসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। রপ্তানিকৃত লাইনার, পিস্টন, নজল, বেয়ারিংসহ নানা যন্ত্রাংশ গুণগত মানের দিক থেকে চীন ও জাপানে তৈরি যন্ত্রাংশের চেয়ে অধিকতর টেকসই এবং দামে সস্তা।

স্থানীয় ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, গাড়ির ব্রেকডাম, ইঞ্জিনসহ সব ধরনের যন্ত্রাংশ মেরামত করা হয় এ ধরনের কারখানায়। সাধারণত গাড়ির মালিকরা এখানে স্পেয়ার পার্টসের জন্যই আসেন। নতুনের চেয়ে অনেক কম দামে এসব মালামাল কিনে থাকেন। এখানে গাড়ির কার্টিজ, সকেট জাম্পার, স্প্রিং, হ্যাঙ্গার, ম্যাক্ল জয়েন্ট, বল জয়েন্টসহ সবই মেলে অতি সুলভে। আর যে পার্টস মিলবে না তার পুরনোটি দিলে নতুনের মত তৈরিও করে দেয়া হয়। এসব যন্ত্রাংশের দাম গাড়ির মডেল অনুযায়ী হয়ে থাকে।

ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা গাড়ি চোর সিন্ডিকেটের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে চোরাই যন্ত্রাংশ এনে বিক্রি করেন। তবে সংশিস্নষ্টরা এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এখানে গাড়ির সাইড গস্নাস বা বডির যন্ত্রাংশ বিক্রি হয় না যা চোরাই হিসাবে ধরা হয়। মাদকাসক্ত যুবক ও ছিঁচকে চোর এসব যন্ত্রাংশ চুরি করে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে। অল্পসংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য সবাইকে ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

ধোলাইখালের প্রবীণ ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন মিয়া জানান, ধোলাইখালের তৈরি পার্টস ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ভুটানসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।

ধোলাইখাল এলাকার পার্টস শিল্প উন্নয়নে এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৪ সালে একটি প্রতিনিধিদল জাপানে গিয়ে গাড়ি তৈরির কারখানা পরিদর্শনসহ বেশকিছু কারিগরি জ্ঞান অর্জন করে আসে। সেটিই ছিল সরকারি পর্যায়ের প্রথম এবং শেষ উদ্যোগ। তারপর আর কোন ধরনের অভিজ্ঞতা ছাড়াই এখানকার 'মেকাররা' নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে যন্ত্রাংশ তৈরি করছেন। দেশে তৈরি এসব যন্ত্রাংশের গায়ে লেখা থাকে 'মেড ইন জাপান'। তারা বলেন, 'দেশের জিনিসের কদর নাই তাই জাপানের নামেই মাল চালাই।' গাড়ির ইঞ্জিন, পার্টস ছাড়াও ধোলাইখালে রয়েছে ইলেকট্রনিক্স বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরির কারখানা।

স্থানীয় ব্যবসায়ী ফিরোজ আলম জানান, তারা নিজস্ব উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন সকেট ক্যাব্ল, বেঞ্চ ওভার সুইচ, লাইট টেপের মতো সরঞ্জামাদির কারখানা। ২০০১ সালে ছোট পরিসরে আরম্ভ করেছিলেন তার কারখানাটি। বর্তমানে ৩৫ জন কর্মচারি নিয়ে দুইটি কারখানা রয়েছে তার। তিনি জানান, ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জামাদির চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। দেশে তৈরি এসব জিনিসের দাম খুবই কম। দেশীয় শিল্প বাঁচাতে ভ্যাট কর্তৃপক্ষের হয়রানি থেকে মুক্তি দাবি করেন তারা।

সরকার শিল্প উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করলে দেশের সম্ভাবনাময় ধোলাইখালের পার্টস শিল্প ও ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জামাদি অনেক এগিয়ে যাবে। দেশীয় শিল্পের অপার সম্ভাবনাময় এ শিল্পটি দেশের জন্য বয়ে আনতে পারে উজ্জ্বল সম্ভাবনা এমনটিই মনে করেন ধোলাইখালের পার্টস ব্যবসায়ী, কারখানার মালিক-শ্রমিক ও বিশেষজ্ঞ মহল।
Source: Daily Ittefaq

No comments:

Post a Comment