Saturday, January 1, 2011

ধোলাইখালের গলি

ধোলাইখালের গলি
হজহিরুল আলম পিলু




পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার থেকে নারিন্দা মোড় পর্যন্ত যে রাস্তাটি সদরঘাটের দিকে গেছে তার পাশেই ধোলাইখালের অবস্থান। খাল নেই তবুও ধোলাইখাল। শব্দটিতে 'খাল' নামকরণের পেছনে রয়েছে ইতিহাস। ষাট দশকের গোড়ার দিকে ধোলাইখালের সঙ্গে ঢাকার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। এ এলাকাটি ছিল এক সময় ঢাকার প্রধান জলপথ ও নগর রক্ষার পারিখা ও আবর্জনা নিঃসারক। এক সময় এই খাল ঢাকা শহরকে দু'ভাগে বিভক্ত করেছিল। নগর রক্ষা ও জলপথ হিসেবে ব্যবহারের জন্য ঢাকার প্রথম সুবেদার ইসলাম খাঁ এই ধোলাইখালটি কাটিয়েছিলেন। সে সময়ের ইতিহাস মোগলরা যে ধোলাই নদীর কথা বলেছে, সম্ভবত ধোলাই নদী বলতে বুড়িগঙ্গাকে বুঝিয়েছিলেন। দু'ভাবে বিভক্ত এ ধোলাই নদীর একটি শাখা ডেমরার শীতলক্ষ্যা নদীর ও আরেকটি একই নদীর খিজিরপুরে মিলিত হয়েছিল। ধোলাইর যে শাখাটি ডেমরার দিকে গেছে তার পাশে ছিল বেগ মুরাদের দুটি দুর্গ। এ শাখাটি দোলাইখাল নামে পরিচিত। কিছুদিন আগেও পুরান ঢাকার মাঝ দিয়ে যে খালটি বয়ে যেত সেটি ইসলাম খাঁ খনন করেন। যেহেতু এটি দোলাই নদীর একটি শাখার সঙ্গে মিশেছিল তাই খুব সম্ভব এটির নাম হয়েছিল ধোলাইখাল। এটির উৎপত্তি বাবুবাজারের পাকুরতলীর কাছ থেকে জিন্দাবাহার, গোয়ালনগর, নবাবপুর, নারিন্দা, জালুয়ানগর, হাল শরাফতগঞ্জ হয়ে লোহার পুলের নিচ দিয়ে গিয়ে আবার বুড়িগঙ্গায় মিশেছে। জানা যায়, এই কৃত্রিম খালের ওপর মোগলরা দশটি সুন্দর পুল বা ব্রিজ নির্মাণ করেছিলেন। যেমন চানখার পুল, নারিন্দা পুল, বাবুবাজার পুল নাম থাকলেও পুলগুলো হারিয়ে গেছে অনেক আগেই।
পুরান ঢাকার অধিবাসী ও ধোলাইখালের ব্যবসায়ী সুলতান আহমেদ ও শহিদ জানান, তৎকালে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ১৪ আগস্ট বিনোদনের জন্য বুড়িগঙ্গায় নৌকাবাইচ হতো। কিন্তু তখানকার নারীরা বুড়িগঙ্গায় যেতেন না। তাই ১৯৫৭ সাল থেকে পুরান ঢাকার সোবহান সরদার, কালা মোনা, শাহাবউদ্দিনসহ অনেকের উদ্যোগে ধোলাইখালের বুকে প্রতি বছর নৌকাবাইচ হতো। শুধু তাই নয়, অনেকে বড় বড় মাছ ধরতেন এই খালে। বর্তমানে যেমনি ধোলাইখাল সড়কে বড় আকারের যানবাহন চলাচল করে, তেমনি সড়কটি খাল থাকা অবস্থায় এক সময় চলাচল করত বড় বড় পণ্যবাহী নৌকা। তখন নারিন্দা ও আশপাশ এলাকায় লাকড়ি, বাঁশ ও গেণ্ডারির আড়ত থাকায় এসব মালামাল বহনের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌকা, যার ঘাঁটি ছিল ধোলাইখাল।
১৯৬৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এ খালটি ভরাট করেন। খালের ওপর তৈরি করা হয় কাঁচা রাস্তা। সে সময় শুধু ইংলিশ রোডের মোড়ে ছিল ৬-৭টি প্রাইভেট গাড়ির পুরনো যন্ত্রাংশের দোকান। ১৯৬৬ সালের শেষদিকে ওইসব দোকানের মালিক নাজিম, তারা মিয়া, সাজাহান ও বরকত মহাজনরা তাদের ইংলিশ রোডের দোকানগুলো প্রথমে রাস্তার ওপর চট, পাটি, চাটাই বিছিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। যুগের পরিবর্তন ও চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই ধোলাইখাল সড়কের আশপাশে গড়ে উঠেছে প্রায় ৬ হাজার বিভিন্ন গাড়ির যন্ত্রাংশের দোকান ও ওয়ার্কশপ, যা দেশের বৃহত্তম পুরনো যন্ত্রাংশের বাজারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু নেই আগের ধোলাইখালের সৌন্দর্য, সবই হারিয়েছে রাস্তার ওপর রাখা নোংরা আবর্জনায়। এ ব্যাপারে ধোলাইখাল পুকুরপাড় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মনু মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম জানান, ধোলাইখালের এ সড়কটি পুরনো মোটরপার্টস নামে পরিচিত। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতারা আসেন প্রয়োজনীয় পার্টস নিতে। এখানে ছোট-বড় যে কোনো গাড়ির যে কোনো যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় ও মেরামত করা হয়। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর দখলে চলে গেছে ধোলাইখালের রোডের ফুটপাত এবং রাস্তার একাংশ_ যন্ত্রাংশের বাজার। কথিত আছে, নগরীর চোরাই গাড়ি একটি সিন্ডিকেট প্রথমে এখানে আনে, পরে এর যন্ত্র খুলে বিক্রি করে দেয়। ব্যস্ততম এ রাস্তার ওপর গড়ে উঠেছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। রাস্তার ওপর করা হচ্ছে গাড়ি পার্কিং। ফলে পথচারী ও যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে, যার কারণে যানজট
এখানে লেগেই থাকে। তারা আরও জানান, ব্যবসায়ীদের বাঁচার স্বার্থে স্থায়ীভাবে জমির লিজ দেওয়া হোক, যেন ব্যবসায়ীরা নিশ্চিন্তে ব্যবসা করতে পারেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে সবাই এ প্রত্যাশাই করে।
Source: Daily Samakal

No comments:

Post a Comment